ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা

দেওয়ানি লাভ:-

  • ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে এবং ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে । ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সঙ্গে এলাহাবাদের সন্ধি স্বাক্ষর করেন । এই সন্ধির দ্বারা ক্লাইভ নবাবের কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ দুটি লাভ করেন এবং কোম্পানি অযোধ্যায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে ।
  • ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে দ্বিতীয় চুক্তি করেন । এই চুক্তির শর্তানুসারে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সঙ্গে কোম্পানির এলাহাবাদের সন্ধির সময় পাওয়া কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ দুটি কোম্পানি শাহ আলমকে উপহার দেয় । বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা করের বিনিময়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলার বিচারের ভার পায়। এই ব্যবস্থাকে কোম্পানির দেওয়ানি লাভ বলে ।

দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

  • কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর থেকে নবাবের পদ বজায় থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিল কোম্পানি ।
  • পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কোম্পানি বাংলায় যে ক্ষমতা লাভ করেছিল তার কোনো আইনগত বৈধতা ছিল না, কারণ এর প্রতি মোগল সম্রাটের অনুমোদন ছিল না । ১৭৬৫ সালের চুক্তির মাধ্যমে দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানির ক্ষমতা লাভ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের অনুমোদন সাপেক্ষে আইনগত বৈধতা পায় ।

দ্বৈত শাসনব্যবস্থা :-

  • ইস্ট ইন্ডিয়া কােম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে ।
  • কোম্পানি বাংলায় মোহাম্মদ রেজা খাঁ কে এবং বিহারের সিতাব রায় কে নায়েব নাজিম অর্থাৎ নায়েব সুবা পদে নিযুক্ত করে তাদের হাতে বাংলা ও বিহার নিজামত ও দেওয়ানি বিভাগে যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করে। রেজা খাঁকে পরিচালনার জন্য রায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে তাঁর সহকারী হিসেবে কোম্পানি নিযুক্ত করে । অপরদিকে মুরশিদাবাদে দরবার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস সাইকসের ওপর ।
  • ইংরেজ কোম্পানি 1765 খ্রিস্টাব্দের 20 ফেব্রুয়ারি বাংলার নবাব নজম উদ্দৌলা সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর দ্বারা বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকা ভাতার বিনিময়ে নবাবের সকল 'নিজামতি' বা প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির মনোনীত 'নায়েব নাজিম' এর হাতে চলে যায়। নবাব কম্পানি বৃত্তিভোগী তে পরিণত হন।
  • এভাবে 1765 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1772 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় একই সাথে এই দুই ধরনের শাসনকাঠামােকে দ্বৈত শাসন বা 'Dual system of administration' বলা হয়। দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানি পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব।

দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কারণ

  • ইংরেজ কর্মচারীবা বাংলার রাজস্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় ।
  • রবার্ট ক্লাইভ মনে করতেন কোম্পানি সরাসরি শাসনক্ষমতায় এলে অন্যান্য ইউরােপীয় বাণিজ্যগােষ্ঠীর মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে ।
  • প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ব্রিটিশ কর্মচারীর অভাব রয়েছে ।
  • ঐতিহাসিক র‍্যামসে ম‍্যুরের মতে , কোম্পানি নিজে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খােলস ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে চায়নি ।

দ্বৈত শাসনের ফলাফল

  • দেশীয় শিল্পবাণিজ্যের ধ্বংসসাধন: দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকারকে কাজে লাগিয়ে বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়াভাবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের ধ্বংসসাধন ঘটে।
  • কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি: কোম্পানি দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার পেলেও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ না করে তা দেশীয় কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত করে। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থাৎ ইজারাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে চড়া হারে রাজস্ব আদায় শুরু করে। রাজস্ব প্রদানে অক্ষম কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে।
  • কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সুযােগে কোম্পানির কর্মচারীরা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা স্বনামে ও বেনামে বিল অব এক্সচেঞ্জ, বাঁধ-সেতু-রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে।
  • ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈত শাসনের কুফল হিসেবে বাংলাতে মর্মান্তিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বঙ্গাব্দ ১১৭৬ ইংরেজি ১৭৭০ খ্রি.) দেখা দেয়। প্রথমে অনাবৃষ্টির কারণে শস্যহানির ফলে এই দুর্ভিক্ষ ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুর শাসননীতির জন্য তা বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

  • ১১৭৬ বঙ্গব্দ (১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়।
  • ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অনাবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হলে, দুর্ভিক্ষের সূচনা ঘটে।
  • ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক রূপ প্রকাশ পায় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম অঞ্চলে।
  • ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে কৃষকদের মৃত্যু মহামারীর রূপ নেয়।
  • ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম বঙ্গের সর্বত্র এবং পূর্ব-বাংলার পশ্চিমাঞ্চল। তবে এর ভয়াবহ রূপ পেয়েছিলে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে। এর ফলে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ:

  • ইস্ট ইন্ডিয়া কােম্পানির দেওয়ানি লাভ 1765 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কােম্পানি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এর কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। বইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সাম্রাজ্যের প্রচলিত রাজস্ব অপেক্ষা অধিক রাজস্ব আদায় করে, এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসায় লগ্নি করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাংলায় কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করত। ‍্যামসে মূর – এর ভাষায় : “ কোম্পানির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কৃষিক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা ”। নির্মম ভাবে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা , কোম্পানির কর্মচারীদের সীমাহীন লাভের আকাঙক্ষা জনগণকে মৃত্যুমুখী করে তােলে ।
  • দ্বৈত শাসনের কুফল : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু করেন এবং পরবর্তী গভর্নর ভেরেলস্ট ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) এবং কার্টিয়ার ( ১৭৬৯ – ৭২ খ্রিঃ ) এই ব্যবস্থা বহাল রাখেন । কোম্পানি মোহাম্মদ রেজা খাঁ কে নায়েব সুবা পদে নিযুক্ত করে। রেজা খাঁ ও অন্যান্য কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও শােষণ এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল । পার্সিভাল স্পিয়ার আলােচ্য সময়কে ব্রিটিশ কর্তৃক ‘ প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ ’ বলে অভিহিত করেছেন । এমনকি স্বয়ং ক্লাইভও মন্তব্য করেছেন যে , “ পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশে এ অরাজকতা , বিভ্রান্তি , দুর্নীতি ও শােষণ পীড়নের কথা কেউ শােনেনি , যার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই বাংলাদেশ । এত বিপুল সম্পদ আর কোনাে দেশ থেকে লুণ্ঠিত হয়নি । ”
  • অনাবৃষ্টি :শােষণজনিত কৃষি বিপর্যয়ের সাথে অনাবৃষ্টি যুক্ত হলে বাংলার চাষির নাভিশ্বাস ওঠে । বিহার ও বাংলায় এই অনাবৃষ্টি শুরু হয় ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং তা অব্যাহত থাকে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । উপর্যুপরি শস্যহানির ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ( বাংলায় ১১৭৬ সন ) দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসে ।
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত : সরকারের অবিবেচক ও হঠকারী সিদ্ধান্তসমূহ এই দুর্ভিক্ষকে মহামারিতে রূপান্তরিত করে । সরকার সেনাবাহিনীর জন্য লক্ষ লক্ষ মণ খাদ্যশস্য মজুত করলেও প্রজাদের জন্য খাদ্যশস্য সরবরাহ করেনি। সরকার খাজনা মকুবের পরিবর্তে আরও কঠোরতার সাথে খাজনা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন । একদিকে খাদ্যাভাব এবং অন্যদিকে সরকারি নিপীড়ন বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে ।

দ্বৈতশাসনের অবসান:

১৭৭২ খ্ৰীস্টাব্দে ওয়ারেন হেষ্টিংস বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন এবং দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটান। যে সমস্ত কারণে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিলেন:-

  • বাংলায় দ্বৈতশাসনের ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ দেখা দিলে, দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসনব্যবস্থা, শোষণ ও অত্যাচার প্রভৃতির কথা ইংল্যান্ডে প্রচারিত হলে ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সমাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজেকর্মে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয় ।
  • বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভীষিকাময় খবরে ইংল্যান্ডের শাসকবর্গ বিচলিত হয়ে পড়েন এবং উপলব্ধি করেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন আর নিছক একটি বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান নয়, তখন তা একটি সাম্রাজ্য পরিচালনা করে, যা আরও সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা দরকার ।
  • ইংল্যান্ডের শাসকবর্গের কাছে আরও খবর এসে পৌছায় যে, দ্বৈতশাসন বাংলার বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল এবং দূর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছে । কারণ কোম্পানির ‘নায়েব-দেওয়ান’ ও কর্মচারীরা কোম্পানির স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থরক্ষাতেই ব্যস্ত থাকেন ।
  • পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর থেকেই কোম্পানির কর্মচারীরা দুর্নীতি, ঘুষ, ভেট এবং ব্যক্তিগত বাণিজ্যসহ নানান অবৈধ উপায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে দেশে ফিরে গিয়ে মহা আড়ম্বরের সঙ্গে বাস করতে থাকেন । ভারত থেকে আগত এইসব কর্মচারীদের দেখে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হয়ে পড়েন, এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রনে এনে এই সব অসৎ কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সু্যোগ খুঁজতে থাকেন । ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে বলেন যে, ‘কোম্পানির কার্যকলাপ ব্রিটিশ জাতির নামে কলঙ্ক লেপন করেছে, সুতরাং এখনই কিছু করা প্রয়োজন’ ।
  • বাংলা তথা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে সম্পদ লুট করেও কোম্পানির আর্থিক অবস্থার বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি, বরং তাদের আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে । এই অবস্থায় কোম্পানিকে ‘ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড’ লোন দিতে অস্বীকার করে । কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ১০ লক্ষ পাউন্ড ঋণের আবেদন জানায় । তাদের ঋণ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে কিনা তা খতিয়ে দেখবার জন্য ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে । তখন বাংলায় কোম্পানির শাসনের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে । এই কমিশনের রিপোর্ট থেকে ইংল্যান্ডের লোক জানতে পারে যে, কোম্পানি তথা বাংলার দুর্দশা বৃদ্ধির জন্য দায়ী ছিল কোম্পানির নায়েব-দেওয়ান ও অন্যান্য কর্মচারীদের সীমাহীন লাভের আকাঙ্খা ।

পাঁচশালা ও এক্শালা বন্দোবস্ত

  • ১৭৭২ খ্ৰীস্টাব্দে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা অবসানের পর ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচশালা বন্দোবস্ত চালু করেন।
  • ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ ও সর্বাধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য বোর্ডের অধীনে একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন করেন । এই কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে জমি নিলামে ডেকে সর্বোচ্চ মূল্যদাতাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারা দিতেন । একে পাঁচশালা বন্দোবস্ত বলা হত । ইজারাদারদের অধিকাংশই নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালন করত না। ফলে সরকারি কোষাগারে তেমন আয় হত না ।
  • অগত্যা হেস্টিংস পাঁচশালা বন্দোবস্তের পরিবর্তে এক্শালা বন্দোবস্ত চালু করেন । এতেও সরকারের আশানুরূপ রাজস্ব আদায় হত না । কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক বছরের ইজারার শেষে জমিদাররা সরকারি রাজস্ব শোধ না করে জমিজমা ছেড়ে পালাতেন ।

বিকল্প রাজস্ব ব্যবস্থাঃ

  • পাঁচশালা পরিকল্পনার সময় থেকেই অনেকে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তুলেছিল।
  • ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাও প্রথম ১৭৭২ সালে বাণিজ্যের উন্নতির লক্ষ্যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন, তিনি বলেন, রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত করা গেলে কৃষিব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে, আর কৃষির উন্নতি ঘটলে বাণিজ্যও সমৃদ্ধ হবে।
  • স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কৃষিকলাবিদ হেনরি পাত্তুলাে প্রাকৃতিক সম্পদকেই আয়ের মূল উৎস বলে উল্লেখ করে জমিতে চিরস্থায়ী ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করেন।
  • কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় প্ৰস্তাবক ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তিনি বললেন, ভারতের বিধিবিধান অনুযায়ী জমিদাররাই জমির মালিক। অর্থনৈতিক মহলের ফিজিওক্রাটদের ভাবধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি বললেন, যে কৃষিই সামাজিক ধন্যবৃদ্ধির একমাত্র সুত্র এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের ভূমির মালিকানা স্বত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করলে, তাদের উদ্যোগে কৃষির পুনরভু্যুদয় ঘটবে এবং তাতে কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে।
  • ফ্রান্সিসের লেখার প্ৰভাবেই ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট কর্তৃক ১৭৮৪ খ্ৰীস্টাব্দে বিধিবদ্ধ পিট-এর ‘ভারত আইন’-এ রাজা, জমিদার, তালুকদার ও অনান্য ভূস্বামীদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
  • ওয়ারেন হেস্টিংসের ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত এবং একসালা বন্দোবস্ত দ্বারা সরকারের বার্ষিক আয়ের কোনাে নিশ্চয়তা ছিল না। এসব ত্রুটি দূর করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দিয়ে কর্নওয়ালিশকে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাঠান।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

  • ১৭৮৬ সালে কর্ণওয়ালিশ গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন। তিন বছর ধরে বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যপক অনুসন্ধান চালান। ১৭৯০ সালে দেশীয় জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য একটি বন্দোবস্ত করেন যা ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, ইংল্যান্ডের কর্তপক্ষ অনুমোদন করলে এই বন্দোবস্তই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এ পরিণত হবে।
  • এই প্রসঙ্গে কর্ণওয়ালিসের সঙ্গে তাঁর পরিষদের সদস্য জন শোর-এর মতপার্থক্য দেখা দেয়। তিনি বলেন, এবিষয়ে আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। ‘দশসালা’কে স্থায়ী বন্দোবস্তে পরিবর্তন না করে, ধীরে ধীরে একাজে এগোনো উচিত।
  • কিন্তু কর্ণওয়ালিস দাবি করেন, সরকারের হাতে যথেষ্ট তথ্য আছে। তিনি যুক্তি দেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে জমিদাররা কৃষকদের স্বার্থের দিকে আরও বেশি নজর দেবে। ইংল্যান্ডের কতৃপক্ষ কর্ণওয়ালিসের অভিমতকে সমর্থন করেন। ফলে ১৭৯৩ সালে ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ হিসাবে ঘোষিত হয়।
  • প্রথমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এবং পরে বারাণসী, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য

  • সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিএই বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা যারা তাদের সমর্থক হিসাবে কাজ করবে।
  • আয় সুনিশ্চিত করাকোম্পানি আশা করেছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে তারা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে। এর ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা দূর হবে।
  • বাজেট তৈরির সুবিধাআয় সুনিশ্চিত হলে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ সহজ হবে।
  • দেশের সমৃদ্ধি জমিদার জমির ওপর স্থায়ী অধিকার পেলে কৃষির উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করবেন। এতে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরোক্ষে কোম্পানির লাভ হবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলি

  • জমিদার ও তালুকদাররা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে বংশানুক্রমে জমি ভোগ করতে পারবে ।
  • জমিদার ইচ্ছামত জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবে।
  • ভূমিরাজস্বের পরমাণ ১৭৯৩ সালের হারেই নির্ধারিত হবে।
  • নির্ধারিত রাজস্বের শতকরা ৯০ ভাগ সরকার ও ১০ ভাগ জমিদার পাবেন।
  • সূর্যাস্ত আইন অনুসারে জমিদাররা সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
  • নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
  • ভবিষ্যতে খরা, বন্যা, মহামারি বা অন্য কোনো প্রকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মকুব করা হবে না।

সুফল

  • সুনির্দিষ্ট আয়:- এ ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয় সুনির্দিষ্ট হওয়ার ফলে সরকার তার আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। যে কারণে বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়।
  • উৎখাতের আশঙ্কার অবসান। কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হয়। ফলে তারা ইজারাদারদের শোষণ এবং জমি থেকে উৎখাতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।
  • কৃষির উন্নতি:- জমির উপর স্থায়ী মালিকানা লাভ করায় জমিদারগণ জমির উন্নয়নে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। এতে কিছু ক্ষেত্রে জমির উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।
  • অবকাঠামোর উন্নয়ন:- জমির উপর জমিদারের স্থায়ী মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার কারণে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হন। তারা নিজ নিজ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়, উপাসনালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া প্রজাদের কল্যাণের জন্য রাস্তাঘাট, পুল তৈরি, পুকুর খননের মতো কাজ ছাড়াও অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁরা জড়িত হন।
  • আর্থসামাজিক উন্নয়ন:- জমিদাররা জমির মালিক হওয়ার কারণে উৎসাহিত হয়ে পতিত জমি, জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষের ব্যবস্থা করেন। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।
  • অনুগত গোষ্ঠির উদ্ভব:- এই বন্দোবস্তের ফলে সরকারের অনুগত একটি জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। ফলে তাদের সমর্থনে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।

কুফল

  • কৃষকদের উচ্ছেদ এই বন্দোবস্তে জমিদার জমির মালিকানা পায়, কৃষকরা নয়। ফলে, বেশি রাজস্বের আশায় জমিদার চাষিকে ঘনঘন জমি থেকে উৎখাত করত। প্রথম দিকে প্রজাস্বত্ব আইন না থাকায় তাদের ভাগ্যের জন্য তারা সম্পূর্ণভাবেই জমিদারের দয়ার উপর নির্ভর করতো।
  • কৃষকের দুরাবস্থা:- জমিদাররা কৃষকদের ওপর প্রবল অত্যাচার চালিয়ে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করত। ফলে, কৃষকদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে।
  • রাজস্বের হার বেশি জমি জরিপ (জমির গুণাগুণ) না করেই রাজস্বের পরিমাণ ধার্য করা হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজস্বের হার বেশি হয়ে যায়।
  • মহাজনী শোষণ:- অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে কৃষকশ্রেণী মহাজনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হত। ঋণ ফেরৎ নিশ্চিত করার জন্য মহাজনরা কৃষকদের অর্থকরী ফসল, যেমন – নীল, পাট, ইত্যাদি চাষে বাধ্য করে। ফলে কৃষির বাণিজ্যকরণ ঘটে এবং কৃষকদের খাদ্যাভাব প্রকট হয়।
  • পুরোনো জমিদারদের উচ্ছেদ:- ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব জমা না দিতে পারায় বহু পুরোনো জমিদার তাদের জমি হারান।
  • নতুন জমিদারের উত্থান:- পুরোনো জমিদারদের জমিদারি নিলামে উঠলে শহুরে ধনী বনিকরা সেই জমিদারি কিনে নেয়। এইসব ভুঁইফোড় জমিদারদের জমি কিম্বা কৃষকদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রজা শোষণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
  • মধ্য ও উপস্বত্বভােগীর উদ্ভব:-চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ইজারাদার, দর ইজারাদার পত্তনিদার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মধ্যস্বত্বভােগীর উদ্ভব ঘটে। কোম্পানির সঙ্গে জমিদারের যেমন চুক্তি হত, তেমন জমিদারদের সঙ্গেও মধ্যস্বত্বভােগীদের চুক্তি সম্পাদিত হত। এদের সীমাহীন শোষণ চাষ ও চাষিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
  • শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষতি:- শহুরে বণিকরা শিল্প-বাণিজ্য ছেড়ে জমিদারি ক্রয়ে মনোযোগ দিলে বাংলার দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কুটিরশিল্পের কাজেও মানুষ আগ্রহ হারায়।
  • সরকারের ক্ষতি:- সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে পতিত জমি উদ্ধার, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে জমিদারের আয় বাড়লেও সরকার সেই আয়ের কোনো অংশ পেত না।
  • মামলা-মোকান্দমা:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেকটা হঠাৎ করে প্রবর্তিত করা হয়। এর ফলে সঠিক জরিপের মাধ্যমে জমি ভাগ হয়নি। উপরস্তুত নিষ্কর জমির ওপর বেশি করে রাজস্ব নির্ধারিত হয়। জমির সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জমিদাররা একে অপরের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা করতে থাকে।


রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত

অষ্টাদশ শতকের শেষে কোম্পানি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি বাদে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য জায়গায় স্যার টমাস মনরাের নেতৃত্বে এবং বােম্বাই প্রদেশে এলফিনস্টোনের নেতৃত্বে এক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ( ১৮২০ খ্রি . ) , যা রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিতি লাভ করে । মাদ্রাজ বাদ দিয়ে মাদুরাই , কানাড়া , কুরনুল , রায়পুর , কোয়েম্বাটুর , মালাবার , চিংলিপুট ইত্যাদি অঞ্চলে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রচলিত হয় । অধ্যাপক বিপান চন্দ্রের মতে , রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে ‘ চাষিই জমির মালিক ‘ এই নীতি অবশ্য কার্য হয়নি ।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের পটভূমি

দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনে কিছু অসুবিধা থাকায় এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । যথা —

  • দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারশ্রেণির অস্তিত্ব ততটা ব্যাপক ছিল না ।
  • বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জমিদারের অস্তিত্ব থাকলেও তারা সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল ।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি শর্ত অনুসারে 一

  • নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে প্রতিটি কৃষকের সঙ্গে সরকারের সরাসরি জমি বন্দোবস্ত করা হয় এবং কৃষকেরা জমির ভােগদখলি স্বত্ব লাভ করে ।
  • ২০ – ৩২ বছর অন্তর আলােচনার মাধ্যমে ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বাড়ানাে হবে বলে ঠিক হয় ।
  • মােট উৎপাদিত ফসলের শতকরা ৪৫ – ৫৫ ভাগ রাজস্ব রূপে নির্ধারিত হয় ।
  • জমি জরিপের মাধ্যমে এবং উৎপাদনের মাপকাঠিতে জমিকে ৯ ভাগে ভাগ করা হয় ।
  • কৃষকদের জমি ভােগ করার স্বত্ব থাকলেও জমির মালিকানা স্বত্ব ছিল না ।
  • বন্যা বা খরার জন্য শস্যহানি হলেও প্রজারা খাজনা দিতে বাধ্য থাকবে বলে এই ব্যবস্থায় ঘােষণা করা হয় ।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুফল

  • এই বন্দোবস্তে সরকারের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে ওঠায় প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস পায় ও জমি – সংক্রান্ত ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটে ।
  • এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভােগীর কোনাে অস্তিত্ব না থাকায় কৃষকরা অন্যায় জোরজুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায় ।
  • জমিদাররা নিজেদের খেয়ালখুশি মতাে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত না । ফলে কৃষকরা জীবিকার জন্য জমির ওপর নির্ভর করতে পারত ।
  • এই বন্দোবস্তে বেশির ভাগ রায়তেরই ভূমিদাস রাখার ক্ষমতা না থাকায় ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে ।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কুফল —

  • কৃষকরা সরাসরি কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে শােষিত ও অত্যাচারিত হত ।
  • এই ব্যবস্থাতে জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় কোম্পানি ভাড়াটে হিসেবে কৃষক – প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত ।
  • এই বন্দোবস্তে খাজনার হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কোম্পানিকে খাজনা দেওয়ার পর কৃষকের হাতে অবশিষ্ট যা থাকত তা দিয়ে সারাবছর জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ছিল ।
  • বন্যা , খরার মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানি ঘটলেও রায়তদের খাজনা দিতে হত । ফলে তারা জমিরক্ষার তাগিদে সাউকার বা মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে দেনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকত ।


মহলওয়ারি বন্দোবস্ত

জমিদারি বন্দোবস্তেরই এক পরিবর্তিত রূপ ছিল মহলওয়ারি বন্দোবস্ত । সরাসরি কৃষক বা জমিদার নয় , একটি গ্রাম বা মহলের সঙ্গে এই বন্দোবস্ত গড়ে ওঠে বলে এর নাম মহলওয়ারি বন্দোবস্ত । গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চল , উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে এই মহলওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় ( ১৮২২ খ্রি . ) ।

মহলওয়ারি বন্দোবস্ত এর পটভূমি

  • কোম্পানির বাের্ড অব কমিশনারের দুজন সদস্য মি. এডওয়ার্ড কোলব্রুক এবং মি. থান্ট – এর সুপারিশ মেনে বারাণসীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হলেও উত্তর ভারতের অন্যান্য জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রচলন নিয়ে কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় ।
  • বিশেষ কমিশনার মি. এইচ. জি. টাকা , মি. আর. ডব্লিউ কক্স প্রমুখ যে সুপারিশ পেশ করেন তা মেনে ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা ওই অঞ্চলগুলিতে চিরস্থায়ীর পরিবর্তিত ভুমিরাজস্ব প্রবর্তনের মত দেয় ।
  • অবশেষে পরিচালক সভার সম্পাদক হােন্ট ম্যাকিঞ্জি মহলভিত্তিক ভূমি বন্দোবস্তের সঙ্গে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার বেশ কিছু নীতির সংমিশ্রণ ঘটান ।
  • এরপর কোম্পানি সপ্তম আইন জারির মাধ্যমে ( ১৮৯২ খ্রি.) এই ব্যবস্থার প্রচলন ঘটায় ।

মহলওয়ারি বন্দোবস্ত এর শর্তাবলি

  • জমি জরিপ করে প্রতিটি মহল বা গ্রামের ওপর রাজস্ব নির্ধারিত হয় ।
  • গ্রামের ওপর ধার্য রাজস্ব গ্রামবাসীদের মিলিতভাবে দিতে হত ।
  • গ্রামবাসীরা তাদের নির্দিষ্ট রাজস্ব গ্রামপ্রধানের মারফত সরকারের ঘরে জমা করত ।
  • জমির উৎপাদিকা শক্তির হার অনুসারে ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারিত হত ।
  • রায়ত ও সরকারের মধ্যে কোনাে মধ্যস্বত্বভােগীর অবস্থান ছিল না ।
  • প্রতিটি মহল বা মৌজার সঙ্গে ২০ – ৩০ বছরের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত করা হয় ।

মহলওয়ারি বন্দোবস্ত এর উদ্দেশ্য

  • এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সরকার চেয়েছিল ভবিষ্যতে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ।
  • কোম্পানি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভােগীদের বিলুপ্তি চেয়েছিল ।

মহলওয়ারি বন্দোবস্ত এর ত্রুটি

  • এই জমি বন্দোবস্তে জমির ওপর কৃষকের কোনাে মালিকানা ছিল না ।
  • অত্যধিক রাজস্বের হার দিতে গিয়ে কৃষক পরিবারগুলির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় ও দুঃখদুর্দশা বাড়ে ।
  • মধ্যস্বত্বভােগীর জায়গায় গ্রামপ্রধানরা স্বজনপােষণ ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল ।
  • গ্রাম বা মহলের যেসব কৃষক সঠিক সময়ে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হত তাদের সেই বকেয়া রাজস্ব গ্রামের অন্যান্যদের মেটাতে হত , না হলে গ্রামের জমি হাতছাড়া হয়ে যেত ।

মহলওয়ারি ব্যবস্থাকে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে আরও ঢেলে সাজানাে হয়েছিল । বেন্টিঙ্ক নবম রেগুলেশন জারি করে ( ১৮৩৩ খ্রি. ) এই ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করেন এবং নতুন গড়ে ওঠা এই ব্যবস্থা কার্যকর করার দায়িত্ব দেন রবার্ট বার্ডকে ।